গওহর জান
গওহর জান অ্যান্জেলিনা ইওয়ার্ড | |
---|---|
প্রাথমিক তথ্য | |
জন্মনাম | অ্যান্জেলিনা ইওয়ার্ড |
জন্ম | আজমগড়, উত্তর-পশ্চিম রাজ্য, বৃটিশ ভারত | ২৬ জুন ১৮৭৩
উদ্ভব | আজমগড়, উত্তর-পশ্চিম রাজ্য, বৃটিশ ভারত |
মৃত্যু | ১৭ জানুয়ারি ১৯৩০ মহীশূর | (বয়স ৫৬)
ধরন | গজল, ঠুমরি, দাদরা |
পেশা | গায়িকা ও নর্তকী |
কার্যকাল | ১৮৮৭–১৯৩০ |
গওহর জান (২৬ জুন ১৮৭৩ - ১৭ জানুয়ারি ১৯৩০) এক স্বনামধন্য ভারতীয় গায়িকা। হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সংগীতের গজল, দাদরা ও ঠুমরি গোত্রের গানের এক বিরল শিল্পী। ভারতের প্রথম মহিলা সুপারস্টার। তিনিই প্রথম ভারতীয় শিল্পী যাঁর গান গ্রামোফোন কোম্পানি রেকর্ড করে।[১]
জন্ম ও প্রারম্ভিক জীবন[সম্পাদনা]
গওহর জানের জন্ম ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দের ২৬ শে জুন বৃটিশ ভারতের বর্তমানে উত্তর প্রদেশের আজমগড়ে। তার পিতামহ ছিলেন বৃটিশ আর মাতামহ ছিলেন ভারতীয়। তাঁদের মেয়ে ভিক্টোরিয়া ছোট থেকেই নাচগানে পারদর্শী। ভিক্টোরিয়ার বিবাহ হয় শুষ্ক বরফ কারখানার ইঞ্জিনিয়ার উইলিয়াম ইওয়ার্ডের সাথে। তিনি ছিলেন আমেরিকান ইহুদি। গওহর জানের জন্মের সময় নাম ছিল অ্যান্জেলিনা ইওয়ার্ড। ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে উইলিয়াম ও ভিক্টোরিয়ার বিবাহ বিচ্ছেদের পর ভিক্টোরিয়া আন্জেলিনাকে নিয়ে খুব কষ্টের মধ্যে পড়লেন। ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে বারাণসী চলে এলেন। খুরশিদ নাম্নী এক মুসলিম সম্প্রদায়ের সহৃদয় ব্যক্তি ভিক্টোরিয়ার গানের প্রসংশা করলেন এবং তারই বদান্যতায় প্রাথমিক সহায়তা ও মনোবল পেলেন। জন্মসূত্রে গওহর জান খ্রিষ্টান,পরে তিনি ও তার মা বারাণসীতে অবস্থান কালে ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। মায়ের নাম ভিক্টোরিয়া ইওয়ার্ড পরিবর্তে হয় মালকা জান। ছোটবেলা থেকেই পারদর্শিতার কারণে হিন্দুস্থানী গান, কত্থক, ভারতীয় ধ্রুপদী শিল্পকলায় ছিল তার অনায়াস গতি। কিছুদিন বারানসী অবস্থানের পর ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে চলে আসেন দেশের রাজধানী কলকাতায়। তখন মেটিয়াবুরুজে বাস করতেন নবাব ওয়াজেদ আলি শাহ। তার সভাশিল্পী হিসাবে তিন বৎসর থাকার পর নিজে কলকাতা চিৎপুর অঞ্চলে নাখোদা মসজিদের পাশে (বর্তমানে ৯২, রবীন্দ্র সরণীতে) একটি বাড়ি কেনেন। এখানে ছোট গওহরের সংগীত, নৃত্য ও ভাষা শিক্ষা শুরু হয়। মায়ের শিক্ষা ও গুণে এমনিতেই গুণান্বিত ছিলেনই। সেই সাথে বহুবিখ্যাত ওস্তাদের ( যেমন পাতিয়ালা ঘরানার কালু খান, আলি বক্স জার্নেল, কিংবদন্তি কত্থকশিল্পী বৃন্দদিন মহারাজ, ধ্রুপদ শ্রীজনবাঈ, চরণ দাসের বাংলা কীর্তন) কাছ থেকে তালিম নেন এবং অচিরেই নৃত্য ও সঙ্গীত পটিয়সী হয়ে ওঠেন ও খ্যাতি অর্জন করেন। মালকা ও গওহর জানের গানের খ্যাতি শুনে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের তালিম নেন পরবর্তীকালের আর এক কিংবদন্তি বেগম আখতার।
সঙ্গীত জীবন[সম্পাদনা]
কিশোরী গওহর জানের প্রথম অনুষ্ঠান ১৮৮৭ সালে বিহারের দ্বারভাঙা মহারাজের আমন্ত্রণে। কিছু দিনের মধ্যেই তিনি হয়ে গেলেন রাজার সভাশিল্পী। পরে চলে আসেন কলকাতায়। নিজেই স্বাধীনভাবে অনুষ্ঠান করতে থাকেন। ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার অনুষ্ঠানে 'ফার্স্ট ড্যানসিং গার্ল' হিসাবে পরিচিতি পান। এরপর দেশের বিভিন্ন শহরে মেহফিল করে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন। ইতিমধ্যে চিৎপুরের তার বাড়ি কলকাতার বিশেষ দ্রষ্টব্য গওহর বিল্ডিং' (বর্তমানে সেলিম মঞ্জিল) নামে পরিণত। মায়ের মৃত্যুযন্ত্রণার শোক ভুলতে পার্সি অভিনেতা অমৃত কেশব নায়কের (১৮৭৭-১৯০৭) সংস্পর্শে আসেন, ১৯০৪-১৯০৫ সালে বোম্বাই শহরে আসেন। তিনি মাত্র দু-তিন বছরের সম্পর্কে গওহরের জীবনে অনেক খানি জায়গা নিয়েছিলেন। কিন্তু ১৯০৭ সালে অমৃত পরলোকগমন করেন। গওহর তো আর রাত রঙিন করা তবায়েফ ছিলেন না, তিনি ছিলেন জাত শিল্পী। ১৯১০ সালে প্রথম মাদ্রাজের (বর্তমানে চেন্নাইয়ের) ভিক্টোরিয়া পাবলিক হলে সঙ্গীত পরিবেশন করেন এবং সেটা সপ্রশংস তামিল মিউজিক বুকে আলোচিত হয়। তিনি ১৯১১ সালে বৃটিশ রাজা পঞ্চম জর্জের সম্মানে এলাহাবাদে জানকী বাঈয়ের সাথে সঙ্গীত মুবারক হো, মুবারক হো, য়ে হ্যায় তজ্পোশী কা জলসা পরিবেশন করেন। রাজা পঞ্চম জর্জ খুশি হয়ে দুজনকেই এক হাজার গিনি উপহার দিয়েছিলেন।
কলের গান মানেই গওহর জান[সম্পাদনা]
কথাটি সেসময় বহুল প্রচলিত ছিল। কেননা মার্কিন সঙ্গীতজ্ঞ ও রেকর্ডিং ইঞ্জিনিয়ার ফ্রেড গেইসবার্গ (১৮৭৩-১৯৫১) এর তত্ত্বাবধানে গ্রামোফোন কোম্পানি গওহরের গাওয়া খেয়াল (রাগ-যোগিয়া, উত্তর ভারতীয় সঙ্গীত ঘরানার ভৈরব ঠাটের অন্তর্গত) রেকর্ড করলেন। ১৯০২ সালের ৮ই নভেম্বর প্রথমবার ভারতীয় শিল্পীর গান ৭৮ আরপিএম রেকর্ড হিসাবে বের হয়। গওহর শুধু যে হিন্দুস্থানী সঙ্গীতকে জনপ্রিয় করেছিলেন তা নয়। তিনি নিজেও গীতিকার ছিলেন। অমৃত কেশব নায়কের সাথেও অনেক গান লিখেছিলেন। রবীন্দ্র সংগীতও গাইতেন। কবিগুরুর গান তার ভীষণ প্রিয় ছিল। ১৯০২ সাল থেকে ১৯১০ সাল পর্যন্ত দেশ, বিদেশের দশটি ভাষায় বাংলা, হিন্দি, গুজরাটি, মারাঠি, তামিল, আরবি, ফার্সি, পশতু, ফরাসি, ইংরেজী গান করেছেন। গ্রামোফোন কোম্পানি তার এই দশটি ভাষায় প্রায় ৬০০ টি রেকর্ড প্রকাশ করেছিল। সেসময় আর কোনো ভারতীয় শিল্পীর এমন কৃতিত্ব ছিল না।
অনেক খ্যাতিসহ সম্পদ, প্রাচুর্যের অধিকারী হয়েছিলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় ভালবাসায় প্রত্যাঘাত হয়েছিলেন তিনি। যাকে মনের মানুষ ভেবে বয়সে অনেক ছোট তবলাচি সৈয়দ আব্বাসকে বিবাহ করেছিলেন, সে ঠকিয়ে তার সম্পত্তি আত্মসাৎ করে। ফলে মামলা মোকদ্দমায় সর্বস্বান্ত হয়ে একদিন কলকাতার চিৎপুরের বাড়িটাও চোখের জলে ছাড়তে হয়েছিল ভারতের গানের রাণীকে। সেই বেদনা তার নিজের লেখা গানে, তার কণ্ঠে বেজে উঠেছে। শেষমেষ ১৯২৮ সালের ১লা আগস্ট মহীশূর রাজের কৃষ্ণ রাজা ওয়ারিঅর চতুর্থ ডাকে চিরতরে কলকাতা ছাড়লেন। [২]
মৃত্যু[সম্পাদনা]
কিন্তু পারফর্ম না করে অন্যের বদান্যতায় বাঁচার পাত্রী ছিলেন না গওহর। রাজার সভাশিল্পী হিসাবে মাত্র দেড় বছর বেঁচে ছিলেন। ১৯৩০ সালের ১৭ জানুয়ারিতে মাত্র ৫৭ বছর বয়সে প্রয়াত হন।[১]
সম্মাননা[সম্পাদনা]
গওহর জান তার জীবনকালে পেয়েছেন অনেক নজরকাড়া খ্যাতি। কিন্তু শেষে, খ্যাতি ছাড়া খুইয়েছেন সবই, শেষ বয়সে একেবারে নিঃস্ব। মৃত্যুর প্রায় নয় দশক বাদে গুগল ২০১৮ সালের ২৬ শে জুন ভারতের এই গ্রামোফোন কন্যার ১৪৫ তম জন্মদিনে শ্রদ্ধা জানায়।[৩]
তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]
- ↑ ক খ "তার আবদারে ভাড়া করতে হয়েছিল আস্ত ট্রেন! এমনই শিল্পী ছিলেন গওহর জান"।
- ↑ "নিজের সেই মহল্লাতে বিস্মৃত গওহর"।
- ↑ "Gauhar Jaan's 145th Birthday"। Google। ২০১৮-০৬-২৬। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৬-২৪।
- ১৮৭৩-এ জন্ম
- ১৯৩০-এ মৃত্যু
- ২০শ শতাব্দীর ভারতীয় গায়িকা
- মহিলা হিন্দুস্তানি সংগীতশিল্পী
- ২০শ শতাব্দীর ভারতীয় গায়ক
- আর্মেনীয় বংশোদ্ভূত ভারতীয় ব্যক্তি
- কলকাতার সঙ্গীতশিল্পী
- ভারতীয় ধ্রুপদী গায়িকা
- হিন্দুস্তানি সঙ্গীতশিল্পী
- উত্তরপ্রদেশের নৃত্যশিল্পী
- ২০শ শতাব্দীর ভারতীয় নৃত্যশিল্পী
- ১৯শ শতাব্দীর ভারতীয় নৃত্যশিল্পী
- কত্থক নৃত্যশিল্পী
- উত্তরপ্রদেশের সঙ্গীতশিল্পী
- ২০শ শতাব্দীর ভারতীয় নারী শিল্পী
- ১৯শ শতাব্দীর ভারতীয় গায়িকা